ঢাকাMonday , 20 May 2024
  • অন্যান্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মধুপুরের প্রথম শহীদ মিনার

বাবুল রানা
মার্চ ৬, ২০২৪ ৪:২৪ অপরাহ্ণ । ১২৪ জন
link Copied

শহীদ মিনার বাঙালির জাতীয় চেতনা, ভাষা ও সংস্কৃতির চিরন্তন প্রতীক। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সম্মানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৬৭ সালে মধুপুর রানী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে মধুপুরের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয়েছিল মধুপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তি সর্বজন শ্রদ্ধেয় জীবন চৌধুরী সাহেবের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আজ তাঁর স্মৃতি বিজড়িত মধুপুরের প্রথম শহীদ মিনার তৈরির ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা আপনাদের মাঝে উপস্থাপন করছি।

গৌরব দীপ্ত ইতিহাস মোদের,
বাংলা মোদের অহংকার।
বাঙ্গালী চেতনায় গড়েছি মোরা,
বেদনার শহীদ মিনার।

১৯৬৫ সাল। আমি তখন রানী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। বাংলা, ইংরেজী সহ অন্যান্য বিষয় পড়ার সংগে তখন ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ঊর্দূ পড়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। ১৯৬৫ সালেই কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। যুদ্ধের খবরাখবর জানার জন্য পত্রিকা পড়াই ছিল একমাত্র ভরসা। আজকালের মত তখন পত্রিকা এত সহজ প্রাপ্য ছিল না। হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ঢাকা থেকে আসতো তাও আবার একদিন পর- অর্থ্যাৎ ডাকযোগে কয়েকটি ‘‘ইত্তেফাক’’ পত্রিকা মধুপুর আসতো। মধুপুর ক্লাবের সেক্রেটারীর নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত আসতো। আমার প্রয়াত কাকা শ্রদ্ধেয় খগেন্দ্রনাথ চৌধুরী (বৈথুল বাবু) কাবের সেক্রেটারী হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন সকালে আমি পোষ্ট অফিসে গিয়ে দীনেশদার (ডাক পিয়ন) কাছ থেকে উৎসাহ ও আগ্রহ ভরে আগে ভাগেই পত্রিকা নিয়ে এসে পড়তাম এবং স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের যুদ্ধের খবরাখবর সহ অন্যান্য সংবাদ জানাতাম। মূলত তখন থেকেই পূর্ববাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানী জান্তার চরম বৈষম্য মূলক আচরণের কাহিনী জানতে শুরু করলাম। ১৯৬৬ সাল আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলো। তখনই জানতে পারলাম কিভাবে আমাদের সোনালী আঁশ পাট, চা, চামড়া ইত্যাদি রপ্তানী করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের মরুভূমিকে সুজলা সুফলা করা হতো। আমাদের সম্পদ বিক্রি করে কিভাবে বড় বড় শিল্প কারখানা পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল। কৃষি ও শিক্ষাখাতসহ সকল ক্ষেত্রে আমরা পূর্ব বাংলার বাংগালীরা ছিলাম চরম উপেক্ষিত ও বৈষম্যের শিকার। এইভাবে যখন আমাদের দেশাত্বরোধ ও বাঙালী চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল ঠিক তখন লক্ষ করলাম আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় স্থান করে দেয়ার আন্দোলনে যারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আত্মাহুতি দিয়ে ছিলেন সেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরও অনেকে যে গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন সেই দিনটিকেও আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করতে পারছিনা। পাকিস্তানের শাসকরা বাংলা ভাষার অস্তিত্ব মুছে ফেলার নানা ষড়যন্ত্র করছিল। পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কিভাবে এই গৌরবময় ২১ ফেব্রুয়ারীকে স্মরণীয় ও বরণীয় করা যায় সেই চিন্তা তখন থেকেই শুরু হলো।

১৯৬৭ সাল জানুয়ারী মাস। ৯ম শ্রেণী থেকে প্রমোশন পেয়ে নিউ টেন (১০ম শ্রেণী) এর ছাত্র। স্কুলের মাঠে সহপাঠীরা মিলে ক্রিকেট খেলায় মেতে আছি। ময়মনসিংহ গামী একটি বাসের ছাদে কয়েকটি ছেলে স্লোগান দিয়া যাচ্ছে ‘‘জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো’’ ‘‘আইয়ুব মোনায়েম দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই। রাজপথে গুলি কেন? আয়ুব শাহী জবাব চাই’’। খবর নিয়ে জানলাম, ৬ দফা আন্দোলনের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিছিলে পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে বহু হতাহত করেছে। ঢাকায় কারফিউ জারী হয়েছে। খেলা শেষে বিজ্ঞান বিভাগের কতিপয় ছাত্রদের নিয়ে মাঠে মিটিং করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এবাবের ২১শে ফেব্রুয়ারীকে (শহীদ দিবস) ভিন্ন আংগিকে স্মরণ করে দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, শ্রদ্ধা জানাতে হবে বীর শহীদদের। শুধু ছাত্র সমাজ নয় আপামর সাধারণ মানুষদের কেউ এই দিনটির তাৎপর্য্য বোঝাতে হবে এবং তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাই স্কুল চত্বরে অতি অবশ্যই একটি শহীদ মিনার গড়তে হবে- যেখানে এসে মানুষ শ্রদ্ধাভরে শহীদদের স্মরণ করতে পারবে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাকরাইদ কৃষি ফার্ম (বর্তমান বিএডিসি ফার্ম) থেকে ইট সংগ্রহ করে আনা হল, নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ করা হলো। স্কুল গৃহের মাধবী লতা ফুল গাছের পাশের স্থানটি শহীদ মিনার তৈরীর জন্য নির্বাচন করা হলো। কিন্তু মিনারের ডিজাইন বা স্থাপত্য কৌশল আমাদের কারও জানা ছিল না। তৎকালীন সময়ে থানা পর্যায়ে কোন হাইস্কুলে তখনও শহীদ মিনার গড়ে উঠে নাই, তাই ডিজাইন সংগ্রহ করতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল। আমাদের সহপাঠী আঃ হালিম (বর্তমানে শহীদ স্মৃতি স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক) জানালেন তার মামা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, তাই আঃ হালিমের সংগে আরও কয়েকজনকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শহীদ মিনারের মডেল আঁকিয়ে আনিয়ে সেই আদলে তৈরি করা হলো মধুপুর রানী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনারটি।

১৯৬৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভোর বেলায় প্রভাত ফেরী শেষে নব নির্মিত শহীদ মিনারে নগ্নপদে পুষ্প অর্পণের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হলো। তখন থেকে আজ অবধি ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে আমজনতা এখানেই সমবেত হয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে। আমার জানামতে তৎসময়ে ময়মনসিংহ জেলার, টাংগাইল মহকুমার মধুপুর থানার রানী ভবানী স্কুলে নির্মিত শহীদ মিনারটিই স্কুল লেভেলে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার।

স্বৈরাচার আইয়ুব-মোনায়েম খার শাসন আমলে স্কুল ছাত্রদের দ্বারা শহীদ মিনার নির্মাণ এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে ভাষা দিবস পালনকে তখনকার স্থানীয় প্রশাসন ভাল ভাবে দেখেননি। প্রশাসন থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হলে রানী ভবানী স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু মহেন্দ্র লাল বর্ম্মন অত্যন্ত সাহসের সাথে বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়ে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করে তৎকালীন সার্কেল অফিসার জনাব আবু তাহের সরকার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব আলম সাহেবকে বুঝিয়ে বিষয়টি মোকাবেলা করেছিলেন।

অর্ধ শতাব্দীর পুরানো শহীদ মিনারটির বর্তমান অবস্থা দেখলে অনেক কষ্ট হয়। ঐতিহ্যবাহী এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে উপজেলার অনেক দল ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। অথচ জীর্ণ ও ভঙ্গুরদশা এই মিনারের মেরামত বা সংস্কারের দিকে কারও কোন লক্ষ্য নেই। শহীদ মিনার চত্বর প্রশস্তকরণ ও আধুনিক স্থাপত্য শিল্পরীতি অবলম্বনে সহজেই মিনারটিকে আরও আকর্ষনীয় ও যুগোপযোগী করা সম্ভব। সকল রাজনৈতিক দল, স্থানীয় প্রশাসন ও নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া আহ্বান জানাচ্ছি।

পলাশ শিমুলের রক্তিম আভা
মাধবী লতার ঘ্রাণ,
প্রকৃতি থেকে সব হারিয়ে গেছে,
ইতিহাসও ম্রিয়মান।