দেশে প্রতি হাজারে ৯ দশমিক ৫ জন শিশু মায়ের গর্ভে মারা যাচ্ছে। এর বেশিরভাগই মারা যায় রাজশাহী বিভাগে। সবচেয়ে কম মারা যায় ঢাকায়। শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি এই মৃত্যুহার। ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২২’ প্রকল্পের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ সালের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে সামগ্রিক মৃত প্রজনন হার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। মৃতজন্ম সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এ বিভাগে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মের বিপরীতে মৃত অবস্থায় জন্ম ১৫ দশমিক ৮। এক্ষেত্রে পরের অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ বিভাগ। এ বিভাগটিতে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে মৃত জন্মের হার ১৩ দশমিক ৯। ঢাকা বিভাগে মৃত জন্মের হার সবচেয়ে কম, প্রতি হাজারে ৬ দশমিক ৫ জন।
প্রতিবেদনে ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, পল্লী অঞ্চলে নারীদের মধ্যে মৃত সন্তান প্রসবের হার শহরের তুলনায় বেশি। এক্ষেত্রে পল্লী ও শহরের অনুপাত হচ্ছে ১০১:৬.৯। এ ফলাফল ২০২১ সালের জরিপ ফলাফলের ঠিক বিপরীত। আগের বছর শহর অঞ্চলের নারীদের তুলনায় মৃত সন্তান প্রসবের হার বেশি ছিল।
মাতৃগর্ভে সন্তান মৃত্যুর অন্যতম কারণ অজ্ঞতা বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিললাল হোসেন। তিনি বলেন, প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে মায়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। নিয়ম-কানুন তোয়াক্কা করেন না। এছাড়া গ্রামের মায়েদের মধ্যে সচেতনতা কম। অনেক কিছুই তারা জানেন না।
এছাড়া, জৈবিক সমস্যা, শিশু নাড়ি পেঁচিয়ে মৃত্যুও হতে পারে। মায়েদের পুষ্টিহীনতা, অধিক টেনশন, প্রেসার বেড়ে যাওয়াও অন্যতম কারণ। এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিবেদনে আরও যে সব তথ্য আছে:
কিশোর বয়সে সন্তান প্রসব: সর্বশেষ এসভিআরএস জরিপের তথ্যে দেখা যায়, কিশোরীদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী গ্রুপে মা হওয়ার অনুপাত সবচেয়ে বেশি। মোট ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর জন্মের ১৮.০ শতাংশ সংঘটিত হয় এ বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর নারীদের মধ্যে। ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক মা হন। কিশোরী বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার (২০ বছর বা তদূর্ধ্ব) পরের বয়সভিত্তিক নারীদের মধ্যে কিশোরীদের তুলনায় সন্তান প্রসবের হার বেশি।
গর্ভকালীন পরিচর্যা: টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টর (এসডিজি) মধ্যবর্তী সময়ে গর্ভাবস্থা-সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুহার ও অসুস্থতাকে এখনও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অন্যতম বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুসারে, গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে ও প্রসবোত্তর সময়ে উচ্চ মানসম্পন্ন যত্নে অভিগম্যতা থাকা উচিত। ডব্লিউএইচও গর্ভাবস্থায় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিকট কমপক্ষে চারটি পরিদর্শনের পরামর্শ দেয়। এটি স্বাস্থ্য পরিষেবার অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ।
২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে ১৫-৪৯ বছর বয়সী সন্তান প্রসবকারী প্রসূতিদের মধ্যে ৩৪.৩৪ শতাংশ তাদের প্রসবপূর্ব পরিচর্যার জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর নিকট কমপক্ষে চারবার পরিদর্শন করেছেন। সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রসবপূর্ব পরিচর্যা গ্রহণ সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে (৬৫.৭১%)। এর পরের অবস্থান পৌরসভা এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলের (৪৮.৭৯%)। পল্লি এলাকার মায়েদের মধ্যে জাতীয় গড় থেকে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম (২৮.৯০%)। বিভাগসমূহের মধ্যে ২০২২ সালে গর্ভবর্তী প্রসূতিদের প্রসবপূর্ব পরিচর্যার জন্য চার বা তার বেশি বার পরিদর্শন হার ৪৬.২২ শতাংশ নিয়ে খুলনা বিভাগ শীর্ষে অবস্থান করছে। রংপুর বিভাগের গর্ভবতী নারীরা কমপক্ষে চারটি প্রসবপূর্ব পরিচর্যা পরিদর্শনে সর্বনিম্ন কাভারেজ (২১.০২%) পরিলক্ষিত হয়েছে। বরিশাল বিভাগ গর্ভাবস্থায় দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সুপারিশকৃত কমপক্ষে চারটি পরিদর্শন বিবেচনায় নিলে প্রসবপূর্ব পরিচর্যার নিম্নতর দ্বিতীয় অবস্থানে (২২.৮৮%) রয়েছে। মায়ের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাকে গর্ভাবস্থায় প্রসবপূর্ব পরিচর্যার জন্য একটি ইতিবাচক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রসবের স্থান: জরিপে বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিভাগ ভিত্তিক জন্মস্থান উপস্থাপন করেছে। জরিপের নমুনা এলাকার মধ্যে মোট জন্মঘটনের (২৮.৩%) সম্পন্ন হয়েছে বাড়িতে, যা ২০২১ সালের তুলনায় কম। ২০২১ সালে এ হার ছিল ৩৫.২ শতাংশ। সন্তান প্রসবের জন্য পরবর্তী পছন্দ ছিল ক্লিনিক। সেখানে জন্ম হয়েছে ২০.৭ শতাংশ শিশুর। তার পরের অবস্থানে রয়েছে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানে মোট শিশুর ১০.২% ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়া প্রায় ১০.৩ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে তাদের নিজস্ব নমুনা এলাকার বাইরে। এসব জন্মঘটনাগুলোর সময় সনাতন ধাত্রী বা প্রশিক্ষিত প্রসূতি সেবাদানকারী বা উভয়ই উপস্থিত ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আরএইচএফ/এসআর