শবে বরাত আসবে। আজ বা কাল। আহা! কী আনন্দ। সেই শবে বরাত এসে গেছে। আমাদের নরম হৃদয়ে খুশির ঢেউ উপচে পড়ছে। দলবেঁধে ঈদগাহে, রাস্তায় শুরু হতো হইহুলোড়। গ্রামেগঞ্জে দিনটি পবিত্র খুশির দিন। আনন্দের দিন। ধর্মের আবরণ ফেটে পড়ে শান্তির সুবাসে উদ্বেলিত চারদিক। দিঘলিয়া বাজারে মিষ্টি-জিলাপি- বাতাসার দাম বেড়ে যেত। শেষ ভরসা ছিল দোকানের সাধারণ বিস্কুট। রাতে মসজিদের মিলাদে এসব দেওয়া হতো।
বাড়ির পাশে বাজার। শবেবরাতের ভোরে ৩০-৪০টি গরু জবাই হয়ে যেত। ৯টার মধ্যে বেচাবিক্রি শেষ। বাড়িতে বাড়িতে হালুয়া-রুটি তৈরির ধুম পড়ে যেত। কিন্তু আমরা খেতে পারতাম না। রোজা রাখতে হতো। কিছু মানুষের জন্য বসে থাকতাম। আসরের নামাজের পর তারা আসতেন। সাধারণ, গরিব মানুষ, বেশিরভাগ নারী। বুকভরা খুশি নিয়ে তাদের হাতে বারবার হালুয়া-রুটি তুলে দিতাম। অনেক সময় তারা না এলে মনটা খারাপ করে থাকতাম। তাদের সেই হাসিমুখ আজও চোখে ভাসে। বেশিরভাগই চলে গেছেন মায়ার পৃথিবী ছেড়ে। কেমন আছেন জানি না। প্রার্থনা, সৃষ্টিকর্তা তাদের সুন্দরে রাখুন।
আলো শেষে আঁধার নেমে আসে। মাগরিবের পর এশার প্রস্তুতি। মসজিদে মসজিদে মোয়াজ্জিনের ডাক। যাদের আজান দিতে দেখে দেখে একটু একটু করে বড় হয়েছি, সেই দাদা-চাচারা একে একে আমাদের ছেড়ে গেছেন। তাদের কণ্ঠে তেমন সুর ছিল না, ছিল না শুদ্ধ-সঠিক উচ্চারণ। কিন্তু মায়া ছিল, দরদ ছিল। আল্লাহ তাদের মাফ করে দিন।
পাড়ার বন্ধুরা রাতে একসঙ্গে মসজিদে যেতাম। ইমাম সাহেবের নির্দেশনামতে এশা ও নফল নামাজ আদায় করতাম। এরপর মিলাদ শুরু হতো। দীর্ঘ মোনাজাতে মৃতদের মাগফিরাত ও জীবিতদের কল্যাণ কামনা করা হতো। এরপর মিষ্টি-জিলাপি-বাতাসা-বিস্কুট বিতরণ করা হতো। পকেট ভরে যেত। মসজিদে বসে কিছু খেতাম। মাঝরাত পর্যন্ত থেকে বন্ধুরা মিলে বাড়ি ফিরতাম।
পৃথিবী বদলে গেছে। আমাদের নরম শরীর-মনও শক্ত হয়েছে। সেইসব দৃশ্য কমে গেছে। আমরা এখন যার যার তার তার। জীবনের দায় শোধে শহর আটকে দিয়েছে শক্ত নিয়মে। রঙের বাহারে ঢাকা পড়েছে সেই শৈশব।
‘শব’ ফারসি শব্দ। অর্থ রাত বা রজনী। ‘বরাত’ শব্দটিও প্রকৃত অর্থে ফারসি ভাষা থেকে উৎকলিত, যার অর্থ ভাগ্য। এ দুই শব্দের একত্রে অর্থ হচ্ছে ভাগ্যরজনী। শবে বরাত আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ নামে পরিচিত। ১৫ শাবান তথা মধ্য শাবানে পালিত একটি পুণ্যময় রাত। মুসলমানরা রাতটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করে থাকেন।
মুসলমান ধর্মবেত্তাদের মতে, এ রাতে আল্লাহতায়ালা তার রহমতের দ্বার খুলে দেন, পাপী বান্দাদের উদারচিত্তে ক্ষমা করে দেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। বান্দাদের অন্যান্য সব দাবিও পূরণ করেন।