প্রতিমাসেই ভারত থেকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরছেন বহু নারী ও শিশু, যারা এক সময় মানবপাচারকারীদের প্রলোভনে সীমান্ত পেরিয়েছিলেন। চাকরি, বিয়ে কিংবা বিদেশে উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে তারা গিয়েছিলেন ভারতের নানা প্রান্তে। সেখানে নানা রকম নির্যাতন সহ্য করে অনেকেই উদ্ধার হয়ে দেশে ফিরলেও, ফেরার পথ যেমন কঠিন, তেমনি পুনর্বাসনের বাস্তবতাও ভীষণ রূঢ়।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফেরত এসেছে ২১ জন কিশোর-কিশোরী। এর মধ্যে ১০ জনকে আশ্রয় দিয়েছে ‘রাইটস যশোর’ এবং বাকিদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছে ‘জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার’। বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজারের বেশি নারী ও শিশুকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
নড়াইলের সীমা খাতুন (ছদ্মনাম) বলেন, “এক আত্মীয় চাকরির কথা বলে আমাকে কোলকাতায় নিয়ে যায়। পরে বুঝতে পারি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। দেড় বছর গারদের মধ্যে কেটেছে।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, পাচারচক্র প্রতিজনকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার করাতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা নেয়, আর পরে ভারতের অভ্যন্তরে তাদের ২ থেকে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়। সবচেয়ে বেশি পাচার হয় যশোরের পুটখালী, দৌলতপুর, গাতিপাড়া, রুদ্রপুর, চৌগাছা এবং সাতক্ষীরার সীমান্তপথ দিয়ে।
‘রাইটস যশোর’-এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, “মানবপাচার এখনো সীমান্ত অঞ্চলের জন্য বড় হুমকি। তবে আগের তুলনায় পাচার কিছুটা কমেছে। আমরা শুধু উদ্ধারেই থেমে থাকি না—আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসনের দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “ভুক্তভোগীরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও প্রশাসনের সহযোগিতা তেমন পাওয়া যায় না।” ঝিকরগাছার জাহানারা ও পলির ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
সংগঠনগুলোর মতে, পাচারের মূল কারণ দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব। সীমান্ত এলাকায় নজরদারির ঘাটতি এবং দালালদের স্থানীয় প্রভাব পাচার রোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেক পাচারকারী প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে যায়, ফলে অভিযোগ করেও বিচার পাওয়া দুর্লভ হয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় প্রশাসনের কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাচার রোধে শুধু উদ্ধার কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম এবং দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। তবেই দীর্ঘমেয়াদে মানবপাচার রোধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।