আকারে খুবই ছোট, নরম দেহ। গায়ে সাদা মোমের মতো স্তর। দেখতে চিনির দানার মতো। তাই কৃষকেরা এই পোকার নাম দিয়েছেন ‘চিনিপোকা’। এরা পানগাছের পাতা, কাণ্ড ও ডগায় দলবেঁধে থাকে। রস চুষে খায়। ফলে পাতায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তামাটে দাগ দেখা দেয়। কোনোভাবেই পানবরজের এ রোগ দমন করতে পারছেন না রাজশাহীর চাষিরা।
পানচাষিরা বলছেন, তিন বছর আগে তাঁরা প্রথম চিনিপোকার আক্রমণ দেখতে পান। তারপর বহু কীটনাকশক স্প্রে করেছেন; কিন্তু লাভ হয়নি। কেউ ব্যবহার করেছেন নিমের তেল। কেউ পানিতে মরিচের গুঁড়া ও হ্যান্ডওয়াশ মিশিয়ে স্প্রে করেছেন। কেউ আবার পানিতে গুল ও উকুননাশক শ্যাম্পু স্প্রে করেছেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
ভালো মানের এক আঁটি (৬৪টি পাতা) পানের দাম ১২০ টাকা। তবে চিনিপোকায় আক্রান্ত পান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০ টাকায়। চিনিপোকা দমনের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। হাতুড়ে পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষিরা পোকা দমনের চেষ্টা করছেন। কৃষি বিভাগ থেকেও তাঁরা তেমন কোনো পরামর্শ পাচ্ছেন না।
জেলার মোহনপুর, পবা, দুর্গাপুর, বাগমারা ও পুঠিয়া উপজেলায় প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে পানবরজ রয়েছে। বছরে এসব বরজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পান বিক্রি হয়। পানের এই বাজার রাজশাহীর আমের বাজারের চেয়েও বড়। রাজশাহীর মিষ্টিপানের সুনামও সবখানে। তাই গত বছর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রাজশাহীর মিষ্টিপান’। এই মিষ্টিপানের রসই চুষে খাচ্ছে চিনিপোকা।
দুর্গাপুর উপজেলার চাষি মোশাররফ হোসেন জানান, তিন বছর আগে তাঁরা প্রথম চিনিপোকার আক্রমণ দেখেন। চিনিপোকা ওঠে মাটি থেকে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। তবে শীতেও দেখা যায়। বৃষ্টি হলে এ পোকা পাতা থেকে ধুয়ে যায়। চিনির মতো দেখতে এ পোকায় হাত দিলেই গলে যায়।
মোহনপুরের চাঁদপুর গ্রামের পানচাষি আফসার আলী জানান, তিনি ২০ শতাংশ জমিতে পান চাষ করেছেন। তাঁর সবটাতেই চিনিপোকার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। পানপাতার নিচে এই পোকা ডিম দেয়। ওপর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। পাতা উল্টালেই তা চোখে পড়ছে। পোকার আক্রমণে তাঁর বাগানের পান জরাজীর্ণ হয়ে গেছে।
পবা উপজেলার কালুপাড়া গ্রামে শহীদুল ইসলাম জানান, তার বরজে চিনিপোকার আক্রমণ হয়েছে। কীটনাশক কিংবা নিমতেল, ডিটারজেন্ট, এমনকি উকুননাশক ছিটানোর পরেও কাজ হয়নি। ১০ দিনের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক শংকর কে বিশ্বাস বলেন, চিনিপোকার আক্রমণ থাকা পান গ্রহণ করলে হালকা বিষক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের পান একাধিকবার গ্রহণ করলে বমি, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিস, পেটের অস্বস্তি কিংবা অরুচির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণ করা হলে ক্যানসারের ঝুঁকি আছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা জানান, বরজে গিয়ে তাঁরা চিনিপোকার কথা জানতে পারেছেন। এর জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা কোনো কীটনাশক নেই। পান সরাসরি খাওয়া হয় বলে কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি। আপাতত চাষিদের গুল, নিমতেল, হ্যান্ডওয়াশ ও শ্যাম্পু দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে দমন পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আরএইচএফ/এসআর